জন্ম : ১০ই শাবান ১২৭২ হিজরী / ১৮৫৬ ইং
ইনতিকাল :২৫ শে সফর ১৩৪০ হিজরী / ১৯২১ ইং। হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ, ইমামে আহলে সুন্নাত, আ’লা হযরত, ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহঃ) এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিলেন- যখন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের দালাল বাতিল ফের্কাগুলো আরবে ও আজমে- সর্বত্র ইসলামের প্রতিষ্ঠিত আকিদাসমূহের উপর কঠোর আঘাত হানা শুরু করেছিল। আরবের অভিশপ্ত নজদ প্রদেশের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর ভারতীয় অনুসারীরা ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের ঈমান আকিদা বিনষ্ট করছিল, পাক-ভারত উপমহাদেশের ওহাবী আন্দোলনের ঢেউ এসে একের পর এক আঘাত হানতেছিল, ইংরেজদের সহায়তায় তারা বিরাট ধরণের দেওবন্দ ওহাবী মাদ্রাসা তৈরী করে ওহাবী মতবাদ প্রচারে লিপ্ত হয়েছিল, তাকভিয়াতুল ঈমান, তাহযিরুন্নাছ, ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, বারাহীনে কাতেয়া, হেফযুল ঈমান ও বেহেস্তী জেরর প্রভৃতি ঈমান বিধ্বংসী ওহাবী মতবদী কিতাবসমূহ লিখে বিদেশী অর্থানুকূল্যে ছেঁপে ঘরে-ঘরে পৌছিয়ে দেয়া হচিছল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মান মর্যাদার উপর এসব কিতাব দ্বারা জঘন্য আক্রমন পরিচালনা করা হচ্ছিল। উদাহরণ স্বরূপ :এসব কিতাবে লিখা ছিল-“আমাদের নবীজির এলেমের চাইতে শয়তানের এলেম অধিক, নবী মরে পঁচে গলে মাটি হয়ে গেছেন, নবীজীর মর্যদা বড় ভাইয়ের তুল্য খাতামুন্নাবিয়ীন অর্থ শেষ নবী নয়, নবীজীর গায়েবী এলেমের মত এমন এলেম চতুস্পদ জন্তুরও আছে, নামাযে নবীজীর খেয়াল আসার চেয়ে গরু-গাধার খেয়াল আসা অধিক ভাল-ইত্যাদি বেদ্বীনি আকিদাসমূহ। উপরে উল্লেখিত কিতাবসমূহে এসব জঘন্য উক্তি লিখে প্রচার করা হচ্ছিল। এমন এক ঘনঘোর অমানিশা যখন উপমহাদেশের আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, সে সময়ে আল্লাহ্র রহমত স্বরূপ ভারতের বাঁশ বেরেলীতে জন্ম গ্রহণ করেন হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ)। ১২৭২ হিজরীতে ১০ই শওয়াল তারিখ মোতাবেক ১৪ই জুন ১৮৫৬ ঈসায়ী সালে ইমাম আহমদ রেযা খান বেরেলভী
(রহঃ) বেরেলীর এক খান্দানী ঐতিহ্যবাহী পাঠান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সিপাহী বিদ্রোহের ১ বৎসর পূর্বেই তাঁর জন্ম। সুতরাং পরবর্তী আযাদী আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
শিক্ষা : মাত্র তের বৎসর দশ মাস চার দিনে তিনি কোরআন, হাদীস, তাফসীর, আরবী সাহিত্যসহ সমস্ত আকলী ও নকলী এলেম শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ঐদিনেই তিনি আপন পিতা আল্লামা নক্বী আলী খান (রহঃ)-এর তত্ত্বাবধানে প্রথম ফতোয়া লিখে মুফতী পদে সমাসীন হন। মজার ব্যাপার -ঐ দিনেই তার উপর নামায ফরয হয়। এই পদে একাধারে ৫৫ বৎসর দায়িত্ব পালন করে ১৩৪৯ হিজরীতে ৬৮ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিভিন্ন ওস্তাদ ও নিজ প্রতিভার মাধ্যমে ৫৫ প্রকার বিদ্যা বা জ্ঞানের শাখা-প্র শাখায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। জ্ঞানের এতগুলো শাখায় বিচরণ করা এ কথাই প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন যুগের দ্বিতীয় ইমাম আবু হানিফা। আল্লামা ইকবাল (রহঃ) তাঁকে এই উপাধীতেই স্মরন করতেন। দীর্ঘ ৫৫ বৎসর পর্যন্ত তিনি যেসব ফতোয়া প্রদান করেছেন-সেগুলো সম্মিলিত নাম রাখা হয়েছে ফতোয়ায়ে রজভীয়া- ৩০ খন্ডে বিরাট ভলিউমে ছাঁপা হয়েছে। এর বর্তমান হাদীয়া ৩০,০০০/= (ত্রিশ হাজার) টাকা। এই দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী সময়ে আ’লা হযরত জ্ঞানের ৫৫ টি শাখায় প্রায় ১৫০০ কিতাব রচনা করেছেন। আ’লা হযরতের জীবনী গবেষক ডঃ মাসউদ আহমদ বলেন শুধু হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ বা টীকা গ্রন্থের সংখ্যাই ৪৬টি। পবিত্র কালাম মজিদের যে অনুবাদ তিনি রচনা করেছেন-তা অতুলনীয় ও নির্ভুল। এমনকি-গতিশীল বিজ্ঞানেও আ’লা হযরতের অনুবাদের ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। তিনি অনুবাদের নাম রেখেছেন“কানযুল ঈমান” বা ঈমানের খনি। কোরআন মজিদের আকায়েদ সংক্রান্ত আয়াতসমূহের সঠিক অনুবাদ একমাত্র কানযুল ঈমানেই পাওয়া যায়। অন্যত্র তা খুবই বিরল। এজন্যই সৌদী সরকার কানযুল ঈমানের বড়ৎ শত্রু। কেননা, এতে তাদের কৃত অনুবাদের ও আকায়েদের অসারতা ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কানযুল ঈমানের বাংলা অনুবাদ বের হয়েছে চট্টগ্রামে থেকে স্নেহভাজন মাওলানা আবদুল মান্নান কর্তৃক।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আ’লা হযরতের অবদান :
জ্ঞান তাপস আ’লা হযরত (রহঃ) বিভিন্ন ওস্তাদ ব আপন প্রকৃতিগত প্রতিভার মাধ্যমে যে সব বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন- তার সংখ্যা ৫৫টি। তিনি নিজেই এসব বিদ্যার একটি তালিকা তৈরী করে ১৩২৪ হিজরীতে মক্কা শরীফের মুফতী খলিল মক্কী (রহঃ)-এর কাছে পেশ করেছিলেন এবং এগুলোর এযাযত বা অনুমতি সনদও লাভ করেছিলেন। যারা হাকিমুল উম্মত-হাকিমুল উম্মত বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং ৯০০ কিতাবের রচয়িতা বলে তাকে সমাজে বিরাটভাবে তুলে ধরতে চায়, তাদের জানার জন্যই আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ)-এর জ্ঞান শাখার সংখ্যা ও তার প্রণীত গ্রন্থের কিছু পরিচয় তুলে ধরা একান্ত আবশ্যক বলে মনে করছি।
আ’লা হযরতের অর্জিত বিদ্যার সংখ্যা ও তালিকা :-
১.ইলমুল কোরআন, ২. ইলমুল হাদীস, ৩. ইলমে তাফসীর, ৪. ইলমে উসুলে হাদীস, ৫. ইলমে আসমাউল রিজাল (হাদীস বর্র্ণনাকারীদের জীবনী), ৬. ইলমে ফিক্হ, ৭. ইলমে উসুলে ফিক্হ, ৮. ইলমে আকাঈদ ওয়াল কালাম (দর্শন), ৯. ইলমে ফারায়েজ, ১০. ইলমে নাহু, ১১. ইলমে সরফ,১২. ইলমে মা’আনী,১৩. ইলমে বয়ান, ১৪. ইলমে বদী,১৫. ইলমে আরুজ, ১৬. ইলমে মোনাযারা, ১৭. ইলমে মানতিক, ১৮. ইলমুল আদব (সর্ব বিষয়ের সাহিত্য), ১৯. ইলমে ফিকহে হানাফী, ২০. ইলমে জদল মহাযযব, ২১. ইলমে ফালছাফা,২২. ইলমে হিসাব (গণিত), ২৩. ইলমে হাইয়াত জোতির্বিদ্যা), ২৪. ইলমে হান্দাসা (জ্যামিতি), ২৫. ইলমে ক্বেরাত, ২৬. ইলমে তাজবিদ, ২৭. ইলমে তাসাউফ (সুফীতত্ত্ব), ২৮. ইলমে সুলুক (তরিকত জগতে ভ্রমণ), ২৯. ইলমে আখলাক, ৩০. ইলমে সিয়াম, ৩১. ইলমে তারিখ (ইতিহাস), ৩২. ইলমে লুগাত (অভিধান), ৩৩. এ্যারিস মাতী ক্বী, ৩৪. যবর ও মোকাবালাহ, ৩৫. হিসাবে সিত্তানী, ৩৬. লগারিদম, ৩৭. ইলমে তাওকীত (সময় নির্দ্ধরণ বিদ্যা), ৩৮. মুনাযারা ও মারাযাহ, ৩৯. ইলমুল আকর, ৪০.যীজাত, ৪১. মুছাল্লাছে কুরভী, ৪২. মুছাল্লাছে মোসাত্তাহ, ৪৩. হাইয়াতে জাদীদা, ৪৪. মুরাব্বাআত, ৪৫. ইলমে জফর, ৪৬. ইলমে যায়েরজাহ, ৪৭. আরবী পদ্য, ৪৮. ফার্সী পদ্য, ৪৯.হিন্দী পদ্য, ৫০. আরবী গদ্য, ৫১. ফার্সী গদ্য, ৫২.হিন্দী গদ্য, ৫৩. কেতাবাত বা লিখন পদ্ধতি, ৫৪. খত্তে নাস্তালীক পদ্ধতির লিখন (ক্যালিওগ্রাফী), ৫৫. তাজবীদসহ ক্বেরাত।
উপরোক্ত ৫৫টি বিদ্যায় আ’লা হযরতের পান্ডিত্যের ব্যাপারে একটি ঘটনা উল্লেখ করার মত। ১৩২৯ হিজরী মোতাবেক ১৯১১ ঈসায়ী সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলার ডঃ যিয়াউদ্দীন সাহেব রামপুর (ইউপি) হতে প্রকাশিত দবদবা-ই-সিকান্দরী নামক পত্রিকায় চতুর্ভূজ সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন প্রচার করেন। আ’লা হযরত সাথে সাথে উক্ত প্রশ্নের সমাধান দিয়ে অন্য একটি চতুর্ভূজ সংক্রান্ত প্রশ্ন তার উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারেন। স্যার যিয়াউদ্দীন এতে হতবাক হয়ে যান-একজন আরবী জানা আলেম কি করে এই বিদ্যা অর্জন করলেন ? এই ঘটনায় স্যার যিয়াউদ্দীন আ’লা হযরতের ভক্ত হয়ে পড়েন।
আর একটি ঘটনা। গণিত সংক্রান্ত একটি বিষয়ের সমাধানের জন্য স্যার যিয়াউদ্দীন বড় পেরেশান হয়ে পড়েন। অতঃপর প্রফেসার সুলাইমান আশরাফের অনুরোধে তিনি বেরেলী শরীফ আগমন করে অংকটি আ’লা হযরতের দরবারে পেশ করেন। আ’লা হযরত নিমিষের মধ্যে উক্ত অংকের সমাধান পেশ করে দেন। এতে স্যার যিয়াউদ্দিন হতবাক হয়ে যান এবং এক সময় মন্তব্য করেন - “মনে হয় আ’লা হযরত এই বিষয়ে পূর্বেই গবেষণা করে সমাধান তৈরী করে রেখেছিলেন। বর্তমানে ভারতবর্ষে এটা জানার মত লোক নেই”।
(হায়াতে আ’লা হযরত)।
জামাতে ইসলামীর তৎকালীন নায়েবে আমীর কাউছার নিয়াজী বলেন, “আমি মনে করেছিরাম - ইসলামের কোন ইলম সম্পর্কে জানা আমার বাকী নেই। কিন্তু আ’লা হযরতের ফতোয়ায়ে রেজভীয়া পড়ে মনে হলো- আমি ইসলামি জ্ঞান সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি”। (আ’লা হযরত কনফারেন্স করাচী-কাউছার নিয়াজীর পঠিত প্রবন্ধ)।বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মোহাদ্দেছ ইদ্রিস কান্দুলভী আ’লা হযরতের বিখ্যাত নাতিয়া কালাম- “মোস্তাফা জানে রহমত পে লাখো ছালাম” আদ্যেপান্ত পাঠ করে ভাবাবেগে বলে উঠেন “হাশরের দিনে ইমাম আহমদ রেযা (রহঃ) তাঁর অতুলনীয় এই একটি অনুপম কসিদার কারণেই নাজাত পেয়ে যেতে পারেন। (আ’লা হযরত করফারেন্স, করাচী-কাউছার নিয়াজীর জীবনী।)
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ)-এর কতিপয় গ্রন্থ পর্যালোচনা :-আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ) দেড় হাজার কিতাব রচনা করে অতীতের অনেক রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। এক একটি কিতাবের পরিধিও ছিল উল্লেখযোগ্য। ফতোয়ায়ে রেজভীয়া ও কানযুল ঈমান গ্রন্থদ্বয়ই তার প্রমাণ। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আ’লা হযরতের রচিত কিতাবসমূহের মধ্যে নিম্মলিখিত কয়েকটি বহুল পরিচিত ও আলোচিত।
ফতোয়ায়ে রেজভীয়া :
১২৮৬ হিজরী থেকে ১৩৪০ হিজরী পর্যন্ত লিখিত বিভিন্ন বিষয়ের ফতোয়ার সমষ্টি। বর্তমানে ৩০ ভলিউমে সমাপ্ত। হাদিয়া প্রায় ৩০,০০০/= (ত্রিশ হাজার) টাকা। ফিকহী মাছায়েলের এমন কোন শাখা নেই - যা ফতোয়ায়ে রিজভীয়াতে বর্ণিত হয়নি। এক একটি মাসআলার উত্তরে তিনি নির্ভরযোগ্য ফিকাহর অসংখ্য দলীল এ রেফারেন্স উল্লেখ করে প্রশ্নকৃত মাসআলার উত্তর দিয়েছেন। যে কোন দক্ষ আলেম ও মুফতী ফতোয়ায়ে রেজভীয়া পাঠ করলে দলীলের সমাহার দেখে তাকে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। অতি সুহ্ম ও চুলচেরা বিশ্লেষণ সহকারে তিনি প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতেন। ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, বেহেস্তী জেওর নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা গৌরব করে- অথচ এগুলোতে শুধু সংক্ষেপেই উত্তর দেয়া আছে। দলীল খুব কমই দেখা যায়। চোখ বুঝে ভক্তরা বিশ্বাস করে নেন। কিন্তু আ’লা হযরতের প্রত্যেকটি ফতোয়ায় অসংখ্য দলীল আদিল্লা দ্বারা মাসআলাটি পরিস্কার ও বোধগম্য করে তোলা হয়েছে। এখানেই আ’লা হযরতের নিরপেক্ষতার প্রমাণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
কানযুল ঈমান:
কোরআন মজিদের প্রামাণিক ও তাফসলি ভিত্তিক উর্দ্দু অনুবাদ। আ’লা হযরত বিষয় ভিত্তিক আয়াতসমূহের একটি পৃথক তালিকা উক্ত অনুবাদে সংযুক্ত করেছেন, যাতে যে কোন বিষয়ে একজন জ্ঞানী ও গবেষক অতি সহজে একাধিক আয়াতের সন্ধান করে নিতে পারেন। বর্তমানে কানযুল ঈমান ও পার্শ্ব টীকা খাযায়েনুল ইরফানের বাংলা অনুবাদ করেছেন স্নেহভাজন মাওলানা আব্দুল মান্নান চট্টগ্রাম। কানযুল ঈমানের অনুবাদ অন্যান্য ১২ জন লেখকের ১২ টি অনুবাদের সাথে তুলনা করে দেখানো হয়েছে যে, আ’লা হযরতের অনুবাদটিই সর্বোত্তম এবং ইসলামী আকিদার সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ। (ইমাম আহমদ রেযা আওর উর্দু তারাজামে কোরআন কা তাকবুলী জায়েযাহ)।
আদ্দৌলাতুল মক্কিয়া বিল মাআদ্দাতিল গাইবিয়া :
এই গ্রন্থটি আরবীতে রচিত। আট ঘন্টা সময়ের মধ্যে আ’লা হযরত আরবের মক্কা শরীফে বসে উক্ত গ্রন্থখানা রচনা করেছেন। মক্কার গভর্ণর (শরীফ)-এর নির্দেশে আ’লা হযরত (রহঃ) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অদৃশ্য বিষয়ক এলম বা ইলমে গায়েব এর উপর দেড়শত পৃষ্ঠার উক্ত কিতাবখানা লিখে ফেলেন। গভর্ণর পান্ডুলিপি দেখে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইলমে গায়েবের দলীলাদি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি এই কিতাব রচনায় কোন রেফারেন্স গ্রন্থ সাহায্য নেয়ার সুযোগই পাননি। শরীফ তাঁর কুতুবখানায় সংরক্ষিত একটি হস্তলিখিত কিতাবের সাথে মিলিয়ে দেখেন-উক্ত গ্রন্থের হুবহু দলীল ও উদ্ধতিসমূহ আদদৌলতুল মক্কিয়ায় বিদ্যমান। এতে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন এবং আ’লা হযরতের হাতে বায়াআত হয়ে যান।
হুসসামুল হারামাঈন :
এই গ্রন্থখানা আ’লা হযরত “আল মো’তামাদ ওয়াল মোস্তানাদ” নামে আরবীতে রচনা করেন। এতে হিন্দুস্থানের ৫ জন আকাবিরীনে দেওবন্দ আলেমের কিতাবসমূহের বিভিন্ন উর্দ্দু উদ্ধৃতি উল্লেখ করে নীচে এগুলোর আরবী অনুবাদ করে ১৩২৪ হিজরীতে মক্কা মোয়াজ্জমা ও মদিনা মোনাওয়ারার ৩৩ জন মুফতীর খেদমতে পেশ করে তাঁদের মতামত চান। উক্ত ৫ জন দেওবন্দী ওলামাদের গ্রন্থসমূহে মন্তব্য ছিল নিম্মরূপ :
১.আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারে, ২. নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মরে পঁচে গলে মাটির সাথে মিশে গেছেন, ৩. নবীজীর এলেমের চেয়ে শয়তানের এলেম বেশী ছিল, ৪. নবীজীর ইলমে গায়েবের মত এমন ইলমে গায়েব চতুস্পদ জন্তুরও আছে, ৫.মূর্খরা বলে থাকে খাতামুন্নাবীয়ীন অর্থ-শেষনবী,কিন্তু খাতামুন্নাবীয়ীন-এর প্রকৃত অর্থ শেষ নবী নয় - বরং মূল নবী। তার পরে এক হাজার নবীর আগমন ধরে নিলেও “খাতমুন্নবীয়ীন বা মূল নবী হওয়ার ব্যাপারে কোন সমস্যা হবে না”। হারামাঈন শরিফাঈনের ৩৩ জন মুফতী উক্ত এবারতসমূহ পর্যালোচনা করে ঐগুলোর লেখকগণকে সরাসরি কাফের ঘোষনা করেন। তাঁর উক্ত ফতোয়ার নাম হয় “হুসসামুল হারমাঈন” বা মক্কা-মদিনার তীহ্ম তরবারী। এটা বাতিল পন্থীদের বিরুদ্ধে আ’লা হযরতের অবিস্মরণীয় অমর কীর্তি। হুসসামুল হারামাঈন-এর বঙ্গানুবাদ করেছেন হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম নঈমী (মুলফতগঞ্জ) এবং সম্পাদন করেছেন স্নেহভাজন আব্দুল মান্নান।
আল কাওকাবাতুশ শিহাবীয়া ফি রদ্দে আবিল ওয়াহাবিয়া:
ইসমাঈল দেহলভীর রচিত ৭০টি কুফরী ও বাতিল আকিদা সম্পন্ন কিতাব “তাকভীয়াতুল ঈমান” এর খন্ডনে লেখা হয়েছে উক্ত গ্রন্থ। সংক্ষেপে ওহাবী আকিদা জানতে হলে উক্তগ্রন্থ পাঠ করা উচিত। ওহাবী সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাতিল আকিদার বিরুদ্ধে আ’লা হযরত একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
আ’লা হযরত (রহঃ) চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীর মোজাদ্দেদ ও সুন্নী আকিদার একমাত্র ইমাম :
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রহঃ) এয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ ১২৮৬ হিজরী সাল হতে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম শুরু করেন এবং চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীর শেষভাগে অর্থাৎ ১২৮৬ হিজরী সাল হতে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম শুরু করেন এবং চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীর প্রথম দশকে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম জনসমক্ষে প্রকাশ পেতে থাকে। একজন মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য তাঁর এলেমের প্রাধান্য বিস্তার, এক শতাব্দীর শেষ ও পরবর্তী শতাব্দীর প্রথম ভাগে সংস্কার কার্যক্রম প্রকাশ এবং এর প্রতি জনগণের স্বীকৃতি প্রদান শর্ত। আ’লা হযরতের মধ্যে এই উভয়বিদ শর্তই বিদ্যমান ছিল বলে সে যুগের আরব ও আজমের মশহুর ওলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখীনে ইজাম তাঁর মোজাদ্দেদ হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। বরিশাল জেলার নেছারাবাদের মাওলানা আজিজুর রহমান নেছারাবাদী (কায়েদ সাহেব) তার মুজাদ্দিদ গ্রন্থে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ) কে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলে স্বীকার করেছেন। তিনি তৎসঙ্গে প্রতি শতাব্দীর একজন করে মোট ১৩ জন মুজাদ্দিদের তালিকাও উক্ত গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন।মক্কা মদিনাসহ সুন্নী জগতের ওলামাগণ বিনা ইখতিলাফে আ’লা হযরতকে চতুর্দশ শতাব্দীর সুন্নী মুজাদ্দিদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আ’লা হযরতের সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান দিক ছিল আকায়েদ সংশোধন করা। ওহাবী-খারেজী-নজদী সম্প্রদায় আরব আজমসহ সর্বত্র বাতিল আকিদা সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির অতল গহবরে নিক্ষেপ করেছিল। তৎকালে তারা ইংরেজদের মদদে নিত্য নতুন বাতিল আকিদার কিতাব রচনা করে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে লাগলো। ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলো। ওহাবী, কাদিয়ানী, বাহায়ী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো। মুসলমান সমাজ শতধা বিভক্ত হয়ে পড়লো। একদিকে মূল ইসলামী আকিদায় বিশ্বাসী সুন্নী মুসলমান. অন্যদিকে নব্য সৃষ্ট ওহাবী, খারেজী, কাদিয়ানী, বাহায়ী ফের্কার নতুন সম্প্রদায়সমূহ আকদাগত দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে পড়লো। এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা আরবে ও ভারতে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করলো। ওহাবীরা কিতাবুত তাওহীদ, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রহঃ) এয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ ১২৮৬ হিজরী সাল হতে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম শুরু করেন এবং চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীর শেষভাগে অর্থাৎ ১২৮৬ হিজরী সাল হতে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম শুরু করেন এবং চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীর প্রথম দশকে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম জনসমক্ষে প্রকাশ পেতে থাকে। একজন মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য তাঁর এলেমের প্রাধান্য বিস্তার, এক শতাব্দীর শেষ ও পরবর্তী শতাব্দীর প্রথম ভাগে সংস্কার কার্যক্রম প্রকাশ এবং এর প্রতি জনগণের স্বীকৃতি প্রদান শর্ত। আ’লা হযরতের মধ্যে এই উভয়বিদ শর্তই বিদ্যমান ছিল বলে সে যুগের আরব ও আজমের মশহুর ওলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখীনে ইজাম তাঁর মোজাদ্দেদ হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। বরিশাল জেলার নেছারাবাদের মাওলানা আজিজুর রহমান নেছারাবাদী (কায়েদ সাহেব) তার মুজাদ্দিদ গ্রন্থে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান তাকভীয়াতুল ঈমান, তাহযিরুন্নাছ, সিরাতে মোস্তাকিম, ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, বারহীনে কাতেয়া, বেহেস্তী জেওর, হেফযুল ঈমান, ইসলামের রুছুম-প্রভৃতি বাতিল ও ক্রিয়াকর্মকে শিরক ও বিদআত বলে প্রচার করতে লাগলো। তারা ঘোষণা করলো- “যারা রাসূলকে হায়াতুন্নবী মানবে, ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে সম্বোধন করবে, মিলাদ কিয়াম করবে, রাসূলকে হাযির নাযির বলে বিশ্বাস করবে, নামাযে রাসূলকে ছালাম করার সময় রাসূলের খেয়াল করবে, যারা“খাতাবুন্নবীয়ীন” শব্দের অর্থ করবে শেষ নবী বলে, যারা আযানের দোয়ায় হাত তুলবে, যারা নবী বখ্শ, গোলাম কাদের, গোলাম জিলানী ও গোলাম আলী ইত্যাদি নাম রাখবে- তারা গোমরাহ, বেদয়াতী ও মুশরিক”। এভাবে ওহাবীরা ভারতের সর্বত্র শিরক বিদআতের বাজার বসিয়ে সুন্নী মুসলমানকে মুশরিক ও বিদআতী বলে আখ্যায়িত করতে লাগলো। ফলে বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার সূত্রপাত হলো। এই সুযোগে ইংরেজরা হিন্দুদের সহায়তায় মুসলমানদেরকে নাস্তনাবুদ করে ছাড়লো। উপরে উল্লেখিত ওহাবী কিতাবসমূহ শিরক-বিদআতের উপরোক্ত ঘোষণাগুলো লিপিবদ্ধ আছে এবং এখনো কাউমী খারেজী মাদ্রাসায় এগুলোর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।ভারতীয় মুসলমানদের এই ঘোর দুর্দিনে যিনি কলম তরবারীর মাধ্যমে বাতিল পন্থীদের উক্ত বে-দ্বীনি লেখনীর মোকাবেলা করে এগুলোকে কচুকাটা করেন সরল ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণকে দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদান করে ইসলামী আকায়েদকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন-তিনিই হচ্ছেন হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ ও ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহঃ)। তাঁর আকায়েদ গ্রন্থগুলো পাঠ করেই আজ আমরা নতুন উদ্যমে বাতিলের মোকাবেলায় সামনে এগিয়ে চলেছি। এদেশে তৈরী হচ্ছে সুন্নী আদর্শের নতুন কাফেলা-আ’লা হযরতের আদর্শের অসংখ্য সৈনিক। আ’লা হযরত (রহঃ) আমাদের ঈমান ও আকায়েদ রক্ষাকারী, বাতিল আকি¦দা হতে মুক্তিদাতা।
তিনি জীবদ্দশায়ই তার আদর্শ সৈনিক তৈরী করে গিয়েছেন। সদরুল আফাযেল মওলানা নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী, হামেদ রেযা খান, সদরুশ শরীয়াহ হযরত মাওলানা আমজাদ আলী, মালিকুল ওলামা মাওলানা যখরুদ্দীন বিহারী-প্রমুখ শাগরিদ মনিষীগণের প্রত্যেকেই ছিলেন যুগের ওহাবী-শিকারী বাজপাখী এবং কলম সম্রাট। সদরুল আফাযেলের আতইয়াবুল বয়ান, তাফসীরে খাজায়েনুল ইরফান, মাওলানা আমজাদ আলীর বাহারেশরীয়ত, মাওলানা হাশমত আলীর ইসলাহে বেহেস্তী জেওর-প্রভৃতি গ্রন্থ ওহাবী কেল্লায় এক একটি এটম বোমা স্বরূপ।
আ’লা হযরত (রহঃ) আধ্যাত্মিক জগতের এক কামেল মহাপুরুষ ছিলেন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ,আরব, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আর অসংখ্য মুরীদ ও ভক্ত। জববলপুর, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তার মুরীদের সংখ্যা সর্বাধিক। অর্ধশতাব্দী ব্যাপী কলমযুদ্ধ চালিয়ে বাতিলের কিল্লায় মারাত্মক আঘাত হেনে এবং দ্বীন ও সুন্নীয়তের মশাল জ্বালিয়ে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহঃ) ২৫ শে সফর১৩৪০ হিজরী মোতাবেক ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ৬৮ বৎসর বয়সে পরপারে মাওলায়ে হাকিকী ও মাহবুবে এলাহী প্রেমাস্পদের সান্নিধ্যে গমন করেন। প্রতি বৎসর বেরেলী শরীফে তাঁর ওফাত দিবসে অগণিত ভক্তগণের উপস্থিতিতে উরছে আ’লা হযরত পালিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা আ’লা হযরত (রহঃ) কে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।
কোন মন্তব্য নেই: